এটি হচ্ছে স্বামী বি আর দীপক ও তার স্ত্রীর অতীত স্মৃতির কথা। দীপক লম্বা, সুদর্শন, ও শিক্ষিত। তিনি চশমা পড়েন। তিনি ভারতে চীনা মানুষের মধ্যে অনেক বিখ্যাত্। কারণ, তিনি বহু বছর ধরে চীন ও চীনা ভাষা নিয়ে গবেষণা করছেন এবং চীনা ভাষার প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছেন। তিনি চীনের বিখ্যাত্ প্রাচীন শিল্প সম্পর্কেও স্পষ্ট ধারণা রাখেন। তাঁর অনূদিত চীনা সাহিত্য অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি অনুবাদ সাহিত্যের জন্য পুরস্কারও পেয়েছেন।
তার স্ত্রী ওয়াং ইয়াও পেইচিং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্প্যানিশ ভাষা বিভাগ থেকে স্নাতক ডিগ্রি নেওয়ার পর জার্মানি ও ইউরোপের অন্যান্য দেশে লেখাপড়া ও কাজ করেছেন। ১৯৯২ সালে দীপকের সঙ্গে তার পরিচয় এবং ২০০৪ সালে বিয়ে। তখন ওয়েবসাইট এত জনপ্রিয় ছিল না, তাঁরা ডাকচিঠি লেখার মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। দীপক বলেন, '১৯৯৩ সাল থেকে আমরা পরস্পরকে কয়েকশ চিঠি লিখেছি। ২০০৪ সালে আমরা বিয়ে করি। সন্তান হওয়ার পর আমরা ভারতে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিই।' উইকেন্ডের একটি দিন। মা ওয়াং ইয়াও দুই সন্তানকে নিয়ে বাসায় ফিরেছেন। শিশুরা বাবাকে জড়িয়ে ধরলো। তারপর ৯ বছর বয়সী বড় ছেলে হানস দীপক দ্রুত দ্বিতীয় তলায় গেল। তারপর সে চীনা ভাষায় মাকে ডিনারের বিষয়ে জিজ্ঞাসা করে এবং বাবার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলে। চার বছর বয়সী ছোট ছেলে জয় দীপক নিজের স্লিপারস খোঁজে। গোটা বাড়ি যেন হঠাত প্রাণ ফিরে পেল।
২০০৮ সালের প্রথম দিকে ওয়াং ইয়াও দীপকের সঙ্গে ভারতে আসার সময় তাঁদের বাসস্থানের অবস্থা খারাপ ছিল। এটি চীনে ওয়াং ইয়াও'র বাড়ির চেয়ে অনেক খারাপ। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, 'এখানকার পরিবেশ চীনের তুলনায় অন্যরকম। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসস্থানগুলো ভালো না। এখানকার বাড়ির দরজা, লক ইত্যাদি চীনের মতো না। কিন্তু এখনে জীবন অনেক শান্ত ও সহজ।'
বর্তমানে দীপক বিশ্ববিদ্যালয়টিতে প্রশিক্ষকের কাজ করছেন এবং ওয়াং ইয়াং ভারতে চীনের জিটিইতে কাজ করেন। প্রতিদিন কাজ করতে যাওয়া, ছেলেদেরকে স্কুলে আনা-নেওয়া, সবজি কেনা, রান্না করা—ইত্যাদি সবকিছু দু'জন ভাগাভাগি করে করেন। বাড়িতে প্রতি সপ্তাহের অর্ধেক সময় চীনা খাবার রান্না হয় এবং বাকি অর্ধেক সময় হয় ভারতীয় খাবার। দু'ছেলে বিশেষ করে মা'র রান্না পছন্দ করে। হানস বললো, 'আমাদের মা চীনা খাবার রান্না করতে পারেন এবং বাবা ভারতীয় খাবার রান্না করতে পারেন। বাবা নিজের স্টাইলে খাবার রান্না করেন। তা অবশ্য বেশ সুস্বাদু হয়।'
হানস স্কুলের ছাত্র। সে চারটি ভাষা বলতে পারে। সে সাংবাদিকদেরকে স্কুলে তাঁর অর্জিত বিভিন্ন পদক দেখায়। সে বলে, 'আমি ইংরেজি, জার্মান, চীনা ও হিন্দি বলতে পারি। আমি মার সঙ্গে চীনা ভাষায় কথা বলি, বাবার সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলি এবং জার্মানিতে নানার সঙ্গে জার্মান ভাষায় কথা বলি। আমি আমার ক্লাসে হিন্দি ভাষায় দ্বিতীয়, ইংরেজি ভাষায় প্রথম ও কম্পিউটারে তৃতীয় স্থানে রয়েছি।'
হানস বলে, তার স্বপ্ন একজন এন্জিনিয়ার হওয়া। সে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া এক হাজার রুপি দিয়ে বই কিনতে আগ্রহী। তার বিশ্বাস, বড় হয়ে তার ছোট ভাইও বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার লাভ করবে।
ছেলেরা গান গায়। বাবা-মার চোখে ভালবাসা ও গর্ব ফুটে ওঠে।
দীপক ও ওয়াং ইয়াও ভলিবলের কোর্টে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন। হানস তাইকোয়ান্দো শেখে। ছোট ভাইও তার সঙ্গে যায়। আর উইকেন্ডে পরিবারের চার সদস্য একসঙ্গে জগিং করে।
ওয়াং ইয়াও ও দীপকের মধ্যে সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে মতভেদ আছে খানিকটা। কারণ চীন ও ভারতের ধারণার ব্যবধান রয়েছে। ওয়াং ইয়াও মনে করেন, ছেলেদের উচিত বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা। কিন্তু বাবা মনে করেন, শিশুদেরকে বেশি চাপ দেওয়া ঠিক না। সুন্দর ও আনন্দিত জীপন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তবে ওয়াং ইয়াও বলেন, তাঁর জীবন অনেক সুখের। তিনি বলেন, 'দু'জনের ভালবাসা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের জীবন সহজ-সরল, কিন্তু সুখের। জাতীয়তা আমাদের জন্য কখনো কোনো সমস্যা হয়ে দেখা দেয়নি।'