চমত্কার আবহাওয়া ও ভৌগলিক দিক থেকে এর অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্তপূর্ণ হওয়ায়, প্রাচীনকাল থেকেই বিদেশিরা এই শহরের প্রতি আগ্রহী ছিল। ১৮৯৭ সালে জার্মানি আক্রমণ করে দখল করে নেয় ছিংতাও শহরটি, এ সময় এ শহরটি জার্মানির কলোনিতে পরিণত হয়। পরবর্তী কালে ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপান জার্মানির কাছ থেকে দখল করে নেয় ছিংতাও।
১৯১৯ সালে এই শহরের সার্বভৌমত্ব পুনরুদ্ধারে জন্ম হয় "৪ঠা মে আন্দোলন"। এরপরে ১৯২২ সালে এ শহরটি চীন প্রজাতন্ত্রের অধিকারে আসে। কিন্তু ১৯৩৮ সালে জাপান পুনরায় এ শহরটি দখল করে নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়কালে "চীন জাতীয়তাবাদী দল" ছিংতাওকে আমেরিকার নৌবাহিনীর পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের প্রধান ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহারের অনুমতি দেয়। পরে ১৯৪৯ সালের জুন মাসে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির "লাল ফৌজ" ছিংতাও শহরে প্রবেশ করে এবং তখন থেকে এ শহরটি গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের অধীনে আসে।
চীনের বৃহত্তম বিয়ার উত্পাদন প্রতিষ্ঠান "ছিংতাও বিয়ার" ও কিন্তু এ শহরেই অবস্থিত। এ শহরটিকে তাই "বিশ্বের বিয়ার শহর" নামেও ডাকা হয়। অনেক পর্যটক এখানে বেড়াতে আসলে ছিংতাও বিয়ার কারখানা ও জাদুঘর পরিদর্শন করেন। প্রতিবছর অগাস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ শেষে এখানে অনুষ্ঠিত হয় "আন্তর্জাতিক বিয়ার উত্সব", যা ১৬ দিনব্যাপী চলে। পৃথিবী বিখ্যাত এই উত্সবে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ দেশি-বিদেশি পর্যটক অংশগ্রহণ করেন এবং এ উত্সবের মাধ্যমে আয়োজকরা পুরো পৃথিবীর সামনে এ শহরের অনন্য বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেন।
ছিংতাও শহরটি পেইচিং থেকে ৮০০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। পেইচিং দক্ষিণ রেল স্টেশন থেকে দ্রুতগতির ট্রেনে মাত্র সাড়ে চার ঘণ্টায় আপনি পৌঁছে যেতে পারেন সমুদ্র তীরবর্তী এ আধুনিক শহরের মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে। এ ছাড়া এখানে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর আছে, তাই চীনের যে-কোনো শহর থেকে এবং বাংলাদেশ থেকেও আপনারা এখানে বেড়াতে আসতে পারেন।
পুরো ছিংতাও শহরটিই আসলে অনেক সুন্দর। তবে প্রধান যেই দর্শনীয় স্থানগুলো আছে তার মধ্যে "সোনালী বালির সৈকত", "চোঙ শান পার্ক", "বাতা কুয়ান", ৪ঠা মে মহাচত্বর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
এ ছাড়া এখানে আছে "লাও শান" বা লাও পর্বত, চান ব্রিজ, বিয়ার জাদুঘর ইত্যাদি। বাতা কুয়ানে প্রাকৃতিক দৃশ্যের পাশাপাশি নানা ধরনের পাশ্চাত্য বৈশিষ্ট্যময় স্থাপনাও এখানে লক্ষ্য করা যায়।
এখানে আছে ১০টি প্রশস্ত রাজপথ এবং এই প্রতিটি রাজপথের দুপাশে আছে বিভিন্ন ধরনের ফুলের বাগান ও গাছপালা। এই এলাকার শান্ত স্নিগ্ধ পরিচ্ছন্ন পরিবেশ আপনাকে দেবে অনাবিল প্রশান্তি। সারা বছর ধরে বিভিন্ন ঋতুতে নানা রঙ নানা বর্ণের ফুল ফোটায় এই এলাকাটিকে বলা হয় "ফুলের পৃথিবী"। তবে এ এলাকাটি কিন্তু শুধু এর মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক পরিবেশের জন্য জনপ্রিয় নয়। এ এলাকায় রাশিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকা, ডেনমার্ক, গ্রিস, স্পেন, সুইজারল্যান্ড ও জাপানসহ ২০টির বেশি দেশ তাদের নিজস্ব স্টাইলে ভবন নির্মাণ করেছে। তাই এই একটি এলাকায় পৃথিবীর অনেক দেশের স্থাপত্যের ধরন ও বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির অনেক নেতা এবং চীনের অনেক রাষ্ট্রীয় অতিথি এখানে অবকাশযাপন করেছেন।
"সোনালী বালির সৈকত"-টির অবস্থান ছিংতাও-এর ফিনিক্স দ্বীপের দক্ষিণপূর্বে, আর এটি পো হাই সমুদ্রের খুব কাছে। এই সৈকতটি পূর্ব থেকে পশ্চিমে অনেকটা অর্ধ চন্দ্রাকারে বিস্তৃত। এর বিশেষ নরম সোনালী বালির বৈশিষ্ট্যের কারণে একে "এশিয়ার এক নম্বর" সমুদ্র সৈকত বলে দাবি করা হয়। এই সৈকতটি ৩৫০০ মিটার দীর্ঘ এবং ৩০০ মিটার প্রশস্ত। এটি চীনের সবচেয়ে সুন্দর সৈকতগুলোর অন্যতম। এখানকার সোনালী বালি, সাদা মেঘ, নীল সমুদ্র এবং চমত্কার প্রবাল মিলে যে অপরূপ দৃশ্য সৃষ্টি করেছে, তা যে-কারোর মনে গভীরভাবে দাগ কাটবে। এখানে একটি বিখ্যাত প্রবাল দ্বীপ আছে যার আকৃতি হচ্ছে ব্যাঙের মতো। এই "পাথরের ব্যাঙ" ভাটার সময় দেখা যায়, আবার জোয়ারের সময় অদৃশ্য হয়ে যায়। তাই একে বলা হয় "রহস্যময় পাথুরে ব্যাঙ"। এখানে অনেক সামুদ্রিক প্রাণী যেমন কাঁকড়া, বিভিন্ন ধরনের শেলফিশ, তারামাছ ইত্যাদি ভেসে বেড়াতে দেখা যায়।
আর আমাদের বন্ধুদের মাঝে যারা সামুদ্রিক খাবার খেতে ভালবাসেন, তাদের জন্য এখানে আছে নানা ধরনের সামুদ্রিক খাবারের আয়োজন। এখানকার রেস্তোরাঁগুলোতে নানা ধরনের তরতাজা ও সুস্বাদু সামুদ্রিক মাছ পাওয়া যায়। বিশেষ করে রেস্তোরাঁগুলোতে এ্যকুরিয়ামে ভেসে-বেড়ানো সম্পূর্ণ জীবন্ত মাছ থেকে পছন্দমতো মাছ বাছাই করে নেওয়া যায়। তার পর অর্ডার দিলে সেই মাছ আপনার চোখের সামনেই ভেজে বা বারবিকিউ করে বা চীনা স্টাইলে রান্না করে আপনার সামনে হাজির করা হবে।
লাও শান ছিংতাওয়ের একটি বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। এই
পাহাড়ের সাথে চীনের প্রাচীন ধর্ম "থাওজিয়াও" এর সম্পর্ক আছে। এই পাহাড়ে আরোহণ আপনার ভ্রমণকে করবে আরও সমৃদ্ধ। তবে এই পাহাড় ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সময় হচ্ছে মার্চ থেকে অক্টোবর পর্যন্ত। কারণ এই সময় প্রচুর বৃষ্টিপাত হওয়ার ফলে চারদিকে অপূর্ব সুন্দর স্নিগ্ধ মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্যের অবতারণা হয়। এখানকার উত্পাদিত শাকসবজি ও ফল খুবই দামি। তবে এখানকার স্থানীয় অধিবাসী ও কৃষকরা খুবই অতিথিপরায়ণ, তারা আপনাকে তাদের সুস্বাদু খাবারের স্বাদ গ্রহণের আমন্ত্রণ জানাতে পারে।
এই শহরের আবহাওয়া অত্যন্ত ভালো, এখানকার বাতাস পেইচিংয়ের মতো শুষ্ক নয়, তুলনামুকভাবে আর্দ্র, এখানে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় আর তাপমাত্রাও বেশ সহনীয়। এ শহরে চারটি ঋতুর পার্থক্য খুবই স্পষ্ট। গ্রীষ্মকালে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়, শরত্কালে আবহাওয়া সবচেয়ে আরামদায়ক, তবে শীতকাল বেশ দীর্ঘ, এসময় তাপমাত্রা অনেক কমে যায় এবং সমুদ্র তীরবর্তী শহর হওয়ায় বাতাস খুব বেশি থাকে। শহরের বার্ষিক গড় তাপমাত্রা ১২.৭ ডিগ্রী সেলসিয়াস, সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৮.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস এবং ১০০ বছরে ধারণকৃত তাপমাত্রায় সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড হচ্ছে হিমাংকের নীচে ১৬.৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস। আগস্ট মাস সবচেয়ে গরম, এ সময় গড় তাপমাত্রা ২৫.৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সবচেয়ে ঠাণ্ডা জানুয়ারি মাসে, এসময় গড় তাপমাত্রা হিমাংকের নীচে ০.৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। (প্রেমা/আলিম)