যৌতুক নিয়ে নানা কথা
  2016-03-05 19:17:22  cri
যৌতুক বাংলাদেশের নারীদের জীবনের সঙ্গে আষ্টেপিষ্টে জড়িত একটি শব্দ। প্রতিনিয়ত যৌতুকের অভিশাপে প্রাণ হারাতে হচ্ছে নারীকে।সরকারের নানা উদ্যোগ থাকা স্বত্তেও যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্তি নেই কন্যাদায়গ্রস্থ পিতার। নানা আইন থাকলেও তাদের রক্ষা করতে পারছে না সে আইন।

বাংলাদেশে যৌতুক প্রথার উত্স কি?

বাংলাদেশে নারীদের সম্পদের ওপর অধিকারের সমান সুযোগ নেই। প্রাচীনকালে যৌতুক প্রথা ছিল এমন যে, যেহেতু সম্পদের ওপর নারীদের সমান সুযোগ ছিল না সেহেতু তাকে একেবারে বিয়ের সময় 'বহনযোগ্য সম্পদ' যেমন স্বর্ণালঙ্কার, গরু, টাকা ইত্যাদি দিয়ে দেওয়া হত। যাতে করে একজন নারী কপর্দকশূন্য না হয়। যেন অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তার একটা সচ্ছলতা থাকে। নিজের বলতে কিছু সম্পদ থাকে। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই প্রথাই প্রায় উল্টেপাল্টে বর্তমানের যৌতুক প্রথায় রূপ নিয়েছে। এখন বরপক্ষ দাবি করে কণেপক্ষের কাছ থেকে যৌতুক নিচ্ছে।

নারীর নিজের অধিকার ও ক্ষমতায়ন সম্পর্কে অজ্ঞতাই যৌতুকের প্রধান কারণ। আর এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমাদের পুরুষ শাষিত সমাজ ব্যবস্তায় যৌতুক একটি প্রথায় পরিণত হয়েছে।

উর্মি : যৌতুক প্রথা বন্ধে দেশে কি কি আইন রয়েছে এবার দেখা যাক.........।

বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রণীত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুসারে যা ২০০৩ সালে সংশোধিত, যৌতুক সম্পর্কে বলা হয়েছে 'বিবাহের কণে পক্ষ কর্তৃক বিবাহের বর কিংবা বরের পিতা মাতা বা বরপক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তিকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষভাবে, উক্ত বিবাহের সময় বা তত্পূর্বে বা বৈবাহিক সম্পর্ক বিদ্যমান থাকাকালে, বিবাহ স্থির থাকিবার শর্তে, বা বিবাহের পণ হিসাবে, প্রদত্ত অতবা প্রদানে সম্মত অর্থ, সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ এবং উক্ত শর্ত বা পণ হিসাবে উক্ত বর বা বরের পিতা, মাতা বা বর পক্ষের অন্য কোনো ব্যক্তি কর্তৃক কণে কিংবা কণে পক্ষের কোনো ব্যক্তির নিকট দাবিকৃত অর্থ সামগ্রী বা অন্যবিধ সম্পদ হলো যৌতুক।

১৯৭০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে যৌতুক প্রথা প্রায় অপরিচিত ছিল। ১৯৪৫-৬০ সাল পর্যন্ত যৌতুকের হার ছিল মাত্র ৩ শতাংশ। এরপর ১৯৮০ সালে আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশে যৌতুক নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু অবাক করা বিষয় হচ্ছে এরপর থেকেই যৌতুকের হার বেড়েছে। ২০০৩ সালে এই হার ছিল ৭৬ শতাংশ।

মান্না : দেশে যৌতুকের হার বাড়ার কারণ কি?

কারণ হিসেবে আমি বলব, বাংলাদেশে আইন না মানার প্রবণতা অনেক বেশি। যে কারণে আমরা যৌতুকের কারণে নির্যাতন, হত্যার মতো ঘটনা ঘটলেও সেগুলোর সঠিক তদন্ত এবং বিচারের আওতায় এনে শাস্তি পাওয়ার ঘটনা নেই বললেই চলে। অনেককে গ্রেফতার করা হলেও কিছু কিছু ক্ষেত্রে অসততা, অসাধু উকিলের তত্পরতার কারণে আইনের ফাঁক গলিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার ঘটনাও কম নয়। যদিও ২০০০ সালে প্রণীত ও ২০০৩ সালে সংশোধিত নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন অনুসারে যৌতুকের কারণে কাউকে মৃত্যু ঘটনোর জন্য দোষী ব্যক্তিদের মৃত্যুদণ্ড, মৃত্যুচেষ্টার জন্য যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং উভয় ক্ষেত্রে অর্থদণ্ড, আহত করার জন্য যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড এবং আহত করার চেষ্টার জন্য অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন পাঁচ বছর এবং অর্থদণ্ডের বিধান রয়েছে। কিন্তু এ সব নিয়ম মানা হয় না বলেই যৌতুক প্রথা বন্ধ তরা যাচ্ছ না।

উর্মি : এ সব আইনের আওতায় কাউকে শাস্তি দেয়া হয়েছে কিনা তা দেখি এবার...।

না। উল্লেখ করার মত শাস্তি দেয়ার মত ঘটনার কথা আমরা বলতে পারবো না। বরং আইনের ফাঁক গলে আসামীর বের হয়ে যাওয়ার ঘটনাই বেশি ঘটছে সমাজে। এতসব আইন থাকলেও তার পরিপূর্ণ ব্যবহার নেই। আর তাই কিছু পরিসংখ্যান আমাদের রীতিমত আতঙ্কিত করে তোলে। মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত যৌতুকের কারণে হত্যা করা হয়েছে ২৩৬ জন নারীকে এবং নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৯৫ জন নারী। চলতি বছর ২০১৫ এর জানুয়ারিতে ১৬ জন নারীকে এবং ফেব্রুয়ারিতে আরো ১৬ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে।

মান্না : যৌতুক প্রতিরোধের আইনটিকে যুগোপোযোগী করা যায় কিনা?

হ্যা। অনেকের মতেই যৌতুক প্রতিরোধে এই আইনটি যুগোপযোগী করা এবং সংশোধন দরকার। দোষীদের আইনের মাধ্যমে কঠোর শাস্তির আওতায় আনলেই সবাই সজাগ হবে। এর পাশাপাশি আমি বলবো একজন নারী যদি তার সামাজিক মর্যাদা, অবস্থান, ক্ষমতায়ন এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা সর্বোপরি স্বাধীনভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে পারে। তার ওপর কেউ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে না পারে সে ব্যাপারে নিজেকে সচেতন হতে হবে। নারীর পণ্যায়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে।

উর্মি : সচেতনতা কি ভাবে সৃষ্টি করতে হবে?

নারীকে পণ্য হিসেবে ভাবা এবং পর্ণের সাথে তুলনা করার মানসিকতা বন্ধ করতে হবে এবং সেটার শুরু হবে প্রতিটি পরিবার থেকে। একজন শিক্ষিত নারী, একজন স্বাবলম্বী নারীকে ফ্রিজ, টেলিভিশন, গাড়ি, গহনা কিংবা ঘর সাজানোর উপকরণের সাথে তুলনা করা যেতে পারে না। এই সচেতনতা তৈরির কাজে তীব্র সামাজিক আন্দোলন দরকার। এটা পরিবার, রাষ্ট্র, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর সহযোগিতা দরকার। যৌতুকের বিরুদ্ধে সামাজিক সচেতনতা দরকার। শুধু নারী নয়; ঘরে ঘরে পুরুষকে সচেতন হতে হবে। একজন বাবাকে সচেতন হতে হবে; যুব সমাজকে সচেতন হতে হবে। আর এই সচেতনতার মূল ভীত তৈরি করবে পরিবার।

মান্না : এ ক্ষেত্রে গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা কি কি তা নিয়ে এবার কথা বলবো।

যৌতুকের কুফল সম্পর্কে গণমানুষকে সচেতন করার জন্য দেশের গণমাধ্যমগুলোর ভূমিকা বেশ কার্যকর ও ফলপ্রসু হতে পারে। জনমানুষকে যৌতুকবিরোধী আইন সম্পর্কে সচেতন করার ক্ষেত্রে গণমাধ্যম সংবাদ, ফিচার, আলাদা সাময়িকী, নাটিকা, বক্তব্য, বিজ্ঞাপন প্রচার করতে পারে। আন্তর্ব্যক্তিক যোগাযোগও ফলপ্রসু ভূমিকা পালন করতে পারে যেমন, মহিলা সমাবেশ, উঠান বৈঠক, কর্মশালা ইত্যাদির মাধ্যমে সচেতন করা। এছাড়া লোকমাধ্যম যেমন যাত্রাপালা এবং শোভাযাত্রা, পোস্টার ইত্যাদির মাধ্যমে যৌতুক বিরোধীর প্রচারণার মাধ্যমে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে যৌতুকবিরোধী সামাজিক আন্দোলনকে জোরদার করার মাধ্যমে যৌতুক নির্মূলের উপায় হিসেবে ভাবা যেতে পারে।

উর্মি : পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টিকে অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে।

এগুলোর পাশাপাশি পাঠ্যপুস্তকেও বিষয়টিকে অন্তর্ভূক্ত করা যেতে পারে। পাঠ্যপুস্তকের মাধ্যমে সচেতনতার বিষয়টি সর্বপর্যায়ে নিয়ে আসা দরকার। তবে উপায়টি শুধু যৌতুকের কুফল এবং আইন সম্পর্কেই জানানো নয়, নারীদের আত্মমর্যাদা এবং ক্ষমতায়ন সম্পর্কে সচেতন হতে বলাটা বেশি জরুরি। সর্বোপরি সচেতনতা এবং মানসিকতার ইতিবাচক পরিবর্তন যৌতুক নির্মূল করতে পারে। কিন্তু একদিনেই সবকিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে এমন নয়। দিনের পর দিন সচেতন করার নিরন্তর প্রচেষ্টার মাধ্যমেই কাঙ্খিত সাফল্য লাভ করা যেতে পারে।

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040