0203
|
'নতুন স্বাভাবিক অবস্থায়'-ও চীনের অর্থনীতি ৭ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখনও বিশ্ব অর্থনীতির উন্নয়নে চীনের অবদান ২৫ শতাংশের বেশি। আসলে চীনের অর্থনীতি এখন অনেক বড় হয়েছে। এখন দেশটির জিডিপি'তে এক শতাংশ প্রবৃদ্ধি ৫ বছর আগের ১.৫ শতাংশ ও ১০ বছর আগের ২.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির সমান।
চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে দেশটির জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর বক্তব্য হচ্ছে: জিডিপি'র প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের চেয়ে কম হলেও, দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল আছে। অর্থনীতি যখন স্থিতিশীল অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে উন্নত হয়, তখন সেটা একটি ভালো প্রবণতা। 'নতুন স্বাভাবিক অবস্থায়' অর্থনীতির কাঠামো পরিবর্তন ও আপগ্রেডেশানের যে কাজ চলছে তা দেশের সার্বিক লক্ষ্যের সাথে সংগতিপূর্ণ।
চীনা জাতীয় পরিষদ কাউন্সিলার অফিসের বিশেষ গবেষক ইয়াং চিং ইউয়ান মনে করেন, ৩০ বছর ধরে চীনা অর্থনীতির দ্রুত প্রবৃদ্ধির পর বর্তমানে দেশের অর্থনীতির মৌলিক উপাদান ও উন্নয়ন-পদ্ধতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। তা ছাড়া, অর্থনীতির উন্নয়নের ধারণা ও উন্নয়ন পরিমাপের পদ্ধতিতেও ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। তিনি বলেন, "আমার মতে অর্থনীতির আয়তন কতো দ্রুত বাড়ছে সেদিকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ না-দিয়ে, অর্থনীতি উন্নয়নের পদ্ধতি এবং কাঠামোর সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া উচিত। ২০১৫ সালে আমরা জিডিপি'তে তৃতীয় শিল্পের অনুপাত ৫০ শতাংশের বেশি দেখেছি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে ভোক্তার অবদান দেখেছি ৬৬ শতাংশ। গত ২০ বছর ধরে বিনিয়োগ ছিল চীনা অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি। এখন যদি দেশের অভ্যন্তরীণ ভোগ মূল চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়, তবে আমাদের অর্থনীতি স্থিতিশীলভাবে উন্নত হবে বলে বলতে পারি।"
২০১৬ সালের শুরুর দিনগুলোতে বেইজিংয়ের চাই সি খো দোকানে ভীড় বেশি হয়। এখানে মূলত বিক্রি হয় সোনার গয়না ও রত্নমণি। এসময় দোকানের ম্যানেজার ওয়াং চুন লি খুবই ব্যস্ত ছিলেন। এসময় দোকানের সকল বিক্রয়-প্রতিনিধির ছুটিও বাতিল করা হয়। ওয়াং ছুন লি বলেন, "নববর্ষের তিনদিনের ছুটিতে দশ-বারো লাখ ভোক্তা আসে আমাদের দোকানে এবং আমাদের বিক্রির পরিমাণ গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ শতাংশ বেশি ছিল।"
পয়লা জানুয়ারি চাই সি খো দোকানের বিক্রির পরিমাণ স্বাভাবিক দিনের চেয়ে ৬০ শতাংশ বেশি ছিল এবং এসময় এখানে প্রতি ঘন্টায় ২ হাজারের বেশি লেনদেন হয়েছে। চীনা চান্দ্রপঞ্জিকা অনুসারে এবার বানরবর্ষ। তাই বানরের ছবিসম্বলিত সোনার গয়নার জনপ্রিয়তা বেড়েছে। পয়লা জানুয়ারি একদিনে চাই সি খো দোকানে বিক্রি হয়েছে বানরের ছবিসম্বলিত ২৫ কেজি সোনার গয়না। ২০১৫ সালে দোকানের মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৩৩০ কোটি ইউয়ান, যা আগের বছরের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। আসলে চাই সি খোন দোকানের বিক্রির এই চিত্র একটি উদাহরণ মাত্র। গোটা চীনের ব্যবসা-প্রতিষ্ঠারগুলোর ক্রয়-বিক্রয়ের চিত্র মোটামুটি এমনই ছিল।
উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৫ সালে চীনা শুল্কের অর্ধেক তথা ৫৪.৮ শতাংশ সেবাশিল্প খাত থেকে এসেছে এবং শুল্ক আয়ের বৃদ্ধির মধ্যে সেবাশিল্পের অবদান ৮০ শতাংশ। এ বছর ইন্টারনেটসম্পর্কিত সেবাশিল্পের শুল্ক আয় ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পায়। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশিত অর্থনৈতিক কর্মক্ষমতা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে চীনা ভোক্তা বাজার ছিল স্থিতিশীল।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র সেন তান ইয়াং বলেন, "২০১৫ সালে ভোগ্যপণ্য বিক্রয়ের পরিমাণ ৩০ ট্রিলিয়ন ১০০ বিলিয়ন ইউয়ান ছিল, যা ২০১৪ সালের চেয়ে ১০.৭ শতাংশ বেশি। তবে এক্ষেত্রে ২০১৪ সালে আগের বছরে চেয়ে যে বৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, ২০১৫ সালে তার তুলনায় ০.৩ শতাংশ কম বৃদ্ধি হয়েছে।"
সেন তান ইয়াং আরও বলেন, চীনে নবোদিত শিল্পগুলো দ্রুত উন্নত হচ্ছে এবং স্মার্ট ও সবুজ পণ্যের জনপ্রিয়তা বেড়েছে। নতুন ধরনের জ্বালানিচালিত গাড়ির বিক্রয় ২০১৪ সালের তুলনায় ৩-৪ গুণ বেশি ছিল। পর্যটকের সংখ্যাও ৪০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে এবং পর্যটন আয় ৪ ট্রিলিয়ান ইউয়ানে উন্নীত হয়েছে। সেন তান ইয়াং বলেন, "আমাদের বৈদেশিক বাণিজ্যের জন্য ২০১৫ ছিল অসাধারণ একটি বছর। শুল্ক বিভাগের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রেনমিনপি'র হিসেবে ২০১৫ সালে আমদানি-রফতানির মোট পরিমাণ আগের বছরের চেয়ে ৭ শতাংশ কম ছিল। তবে বিশ্বব্যাপী আমাদের রফতানি বৃদ্ধি হার অন্য প্রধান অর্থনৈতিক সত্তা ও নবোত্থিত বাজারের চেয়ে বেশি ছিল।"
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এশিয়ায় উচ্চতর বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তিপণ্য রফতানির পরিমাণে চীনের অনুপাত ২০০০ সালের ৯.৪ শতাংশ থেকে ২০১৪ সালে ৪৩.৭ শতাংশে উন্নীত হয়।
তা ছাড়া, চীনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপাত্ত অনুযায়ী, ২০১৫ সালে চীন ৮০০ বিলিয়ন ইউয়ান বৈদেশিক অর্থ ব্যবহার করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬.৪ শতাংশ বেশি। ২০১৫ সালে চীনে বিদেশি পুঁজি বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান ছিল ২৬ ৫৭৫টি, যা ২০১৪ সালের তুলনায় ১১.৮ শতাংশ বেশি।
২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সংকট দেখা দেওয়ার পর থেকেই চীনের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে। এ সংকট মোকাবিলার জন্য চীন সরকার অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করে। সরকারি বিনিয়োগের সাহায্যে অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার হয়। তখন ৪ ট্রিলিয়ন ইউয়ানের বিনিয়োগ অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেললেও, পরবর্তী কয়েক বছরে চীনের রিয়াল এস্টেট ব্যবসায় ধস নামে।
চীনা রাষ্ট্রীয় পরিষদ উন্নয়ন গবেষণালয়ের গবেষক ছাও লি ছুন মনে করেন, ২০১৫ সালে জটিল ও পরিবর্তিত আন্তর্জাতিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে চীনা অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখা সহজ কাজ হবে না। তিনি বলেন, "২০১৫ সালে চীনা অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধির হার কমে গেলেও, সার্বিকভাবে অর্থনীতি ছিল স্থিতিশীল। সে বছর প্রথম তিন প্রান্তিকের প্রবৃদ্ধি হার ৭ শতাংশ এবং চতুর্থ প্রান্তিকের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬.৮ শতাংশ।" (শিশির/আলিম)