শিশুবিয়ে বন্ধে চাই সমন্বিত উদ্যোগ
  2016-01-31 15:00:10  cri

প্রতিদিন খবরের কাগজ খুললেই নজরে পড়ে শিশুবিয়ের নানা রকম সংবাদ। ছোট্ট শিশুকন্যাটির অসময়ে মা হতে গিয়ে মৃত্যু-এ যেন আমাদের নিয়মিত বিষয়। কিংবা বিবাহিত শিশুকন্যাটিকে যৌতুকের জন্য নির্যাতন করা, হত্যা করা অহরহ ঘটছে দেশে। এ থেকে আমাদের মুক্তি নেই। এ সবগুলো সমস্যা একই সূত্রে গাথা। এ সব সমস্যার মূলে রয়েছে শিশুবিয়ে অর্থ্যাত বাল্যবিবাহ। বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী যেহেতু ১৮ বছরের নিচে সবাই শিশু তাই আমি 'বাল্যবিয়ে' শব্দটি ব্যবহার না করে 'শিশুবিয়ে' শব্দটি ব্যবহার করতে চাই।

দরিদ্রতা, শিক্ষা, সচেতনতার অভাব, সামাজিক নিরাপত্তার অভাব ও গোড়ামির কারণে বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়ে শিশুর ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। সরকারের কিছু উদ্যোগ, বেসরকারি কিছু উদ্যোগ থাকলেও আমাদের হতাশই হতে হয় বার বার। টিভি চ্যানেল যখন আমরা দেখি দূরে কোথাও নয়; স্বয়ং রাজধানীর পাশের নারায়নগঞ্জেই সকলের চোখকে ফাঁকি দিয়ে অহরহ শিশুদের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। তখন সব উদ্যোগই যেন মুখ থুবরে পরে!

নারীর ক্ষমতায়ন বর্তমান সরকারের অন্যতম অগ্রাধিকার। নারীদের জন্য এ সরকার নানা রকম উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তবে আমার মনে হয়, নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করতে হলে তার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনৈতিক ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সবার আগে জরুরী। বাংলাদেশর বিদ্যমান আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শিক্ষা ও নিরাপত্তার অভাব ও গতানুগতিক মানসিকতার জন্য শিশুবিয়ের হার বেশি বলে মনে করা হয়। তবে, সচেতনতার অভাব এক্ষেত্রে বড় একটি নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। আর এই সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য যে বিষয়টি সবার আগে জরুরী তা হলো শিক্ষা। শিক্ষার বিকল্প নেই। দেশে নারীশিক্ষা সম্প্রসারণ সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বিশেষ করে মেয়েদের প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক এমন কি উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা অবৈতিনক করা হয়েছে। এরচেয়ে সড় সুযোগ আর কি হতে পারে!

তাহলে এখন প্রশ্ন হচ্ছে সচেতনতা নিয়ে। অভিভাবকরা তাদের কন্যাদের লেখাপড়া না শিখিয়ে তাদের শিশুবয়সে বিয়ে দিতেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন বেশি। কিন্তু কেন? উত্তর ওই একটাই সচেতনতার অভাব। দারিদ্রতার দোহাই দিয়ে তারা কন্যা সন্তানকে বিয়ে দিচ্ছেন। অথচ খবর নিলে জানা যাবে এসব অভিভাবকের অধিকাংশই বিনাবেতনে শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানেন না। সুতরাং এটাকে আমরা সচেতনতার অভাব বলতে পারি।

বাংলাদেশে সেই প্রচীনকাল থেকেই দারিদ্রের কারণে বিদ্যমান সামাজিক অবস্থায় নারীকে বোঝা মনে করা হয়। তাই বাবা-মা যতদ্রুত সম্ভব চায় মেয়ের বিয়ে দিতে। আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তাবোধের অভাবের কারণেই এমনটি হয়ে থাকে। ১৮ বছর হতে না হওয়ার আগেই দেশের প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি মেয়ের বিয়ে হয়ে যায়। ২০১৪ সালের ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন বলছে, ১৫ বছরের কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের হার বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি। কি ভয়ঙ্কর তথ্য! ২০১৫ সালে দাড়িয়ে আমরা জানছি এমন তথ্য।

তার মানে, বিদ্যমান আইনে বিয়ের বয়স কমপক্ষে ১৮। কিন্তু বাস্তবে তারও তিন বছর আগেই এদেশের মেয়েদের বিয়ের হার সবচেয়ে বেশি। এমন একটি পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি বাধাগ্রস্ত হয় নারীর শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর অধিকাংশ মেয়েরাই আর স্কুল যেতে পারে না। ফলে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয় দেশের প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী। শিক্ষিত মায়ের মাধ্যমে শিক্ষিত জাতি গঠন বাধাগ্রস্ত হয়। সেই সাথে নারীর ভবিষ্যত আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের পথও রুদ্ধ হয়ে যায়। ক্ষমতায়নতো অনেক পরের কথা। শিশুবিয়ের ফলে প্রসূতি ও শিশু মৃত্যু, দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি নারীর স্বাভাবিক অনুসঙ্গ হিসেবে দেখা দেয়।

দেশে ১৮ বছরের আগে বিয়ে আইনত নিষিদ্ধ হলেও আমাদের ৬৪ শতাংশ মেয়েরই ১৮'র আগেই বিয়ে হয়ে যায়। শিশুবিয়ে সংক্রান্ত নতুন আইন করার আগে মেয়েদের বিয়ের বয়স কমানোর এটি প্রস্তাব হচ্ছিল। তবে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে মেয়েদের বিয়ের ন্যূনতম বয়স ১৮ বছরই থাকছে। তাই বর্তমান আইনে বিয়ের বয়সের কোনো হেরফের হচ্ছে না। শিশুবিয়ে রোধে ১৯২৯ একটি আইন (বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন-১৯২৯) করা হয়। ওই আইনের ২ ধারাতেই 'শিশু'র সঙ্গা নির্ধারণ করা হয়েছে পুরুষ হলে ২১ বছরের নীচে ও নারী হলে ১৮ বছরের নীচে। ছেলেদের ২১ আর মেয়েদের ১৮ এর কম হলে তা শিশুবিয়ে হিসেবে পরিচিত। আইনে এধরনের বিয়েকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

এ আইনে শিশুবিয়ে বলতে কেবল নারী শিশুদের বিয়ের কথাই বলা হয়নি। ছেলেদের বয়সও ২১ এর কম হলে তা শিশুবিয়ের অন্তর্ভূক্ত। বিয়ের কোনো এক পক্ষ আইনানুযায়ী বিয়ের জন্য উপযুক্ত বয়সের না হলেও তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। তবে, এ আইনে শাস্তির যে মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে তা অপ্রতুল। শিশুবিয়ের জন্য শাস্তি নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র এক মাস কারাদণ্ড। এ শাস্তি কেবল যে শিশুবিয়ে করবে তিনিই পাবেন তা নয়, শিশুবিয়ের উদ্যোক্তা, সম্পাদনকারী, বাবা-মা এমনকি অভিভাবকরাও শাস্তির আওতায় আসতে পারে। আর এক্ষেত্রে জরিমানা নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র এক হাজার টাকা।

১৯২৯ সালের পর ১৯৮৪ সালের আইনটির কিছু সংশোধন করা হয়। এরপর ২০১৩ সালে ১৯২৯ সালের আইনটি বাতিল করার প্রস্তাব করে নতুন একটি আইনের খসড়া প্রণয়ন করা হয়।

প্রস্তাবিত আইনে শিশুবিয়ে বন্ধের জন্য আগের শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে দুই বছর কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয় যা খুবই যুগোপযুগি। বর্তমান সরকার শিশুবিয়ে প্রতিরোধে অঙ্গীকারাবদ্ধ। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে ১৫ বছরের নিচে বিবাহের সংখ্যা শুন্যে এবং ২০৩৫ সালের মধ্যে ১৮ বত্সরের নিচে বিয়ের সংখ্যা শুন্যে নামিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েছেন।

শিশুবিয়ে রোধ করার একটি বড় অস্ত্র হচ্ছে দারিদ্র দূর করা। দারিদ্র সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার কারণ। কাজেই দারিদ্র দূর করতে পারলে শিশুবিয়ের হার অনেকটা কমে আসবে। দেশের দারিদ্রের হার ইতিমধ্যেই ৩১ ভাগে কমিয়ে আনা হয়েছে। এ লক্ষ্যে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

(মান্না)

© China Radio International.CRI. All Rights Reserved.
16A Shijingshan Road, Beijing, China. 100040