0127
|
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে দেওয়া ভাষণে প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং আশা করেন, সদস্যদেশগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় এআইআইবি একবিংশ শতাব্দির একটা কার্যকর বহুপাক্ষিক উন্নয়ন ব্যাংক হিসেবে সুনাম অর্জন করবে। তিনি বলেন, এই ব্যাংক মানবজাতির অভিন্ন লক্ষ্যের কমিউনিটি নির্মাণের নতুন প্ল্যাটফর্মে পরিণত হবে এবং এশিয়া তথা বিশ্বের অর্থনীতিতে নতুন চালিকাশক্তি যোগাবে।
সি চিন পিং জোর দিয়ে বলেন, এআইআইবি'র আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠা ও উদ্বোধন কার্যকরভাবে এশীয় অঞ্চলের অবকাঠামো ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানোর পাশাপাশি এতদঞ্চলের আন্তঃযোগাযোগ ও অর্থনীতির একীকরণ প্রক্রিয়াকেও সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এআইআইবি এশিয়ার উন্নয়নশীল সদস্যদেশগুলোর বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়াতে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করবে বলেও তিনি আশা প্রকাশ করেন।
এদিকে, একইদিনে অনুষ্ঠিত এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি)-র নির্বাহী পরিষদের প্রতিষ্ঠা-সম্মেলনে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি খ্য ছিয়াং বলেছেন, এশিয়া হচ্ছে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল উত্স। তিনি বলেন, চীনের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ৫৭টি দেশের এআইআইবি বিশ্বের অন্যান্য বহুপক্ষীয় উন্নয়ন ব্যাংকের পাশাপাশি নিজস্ব ভূমিকা পালন করে যাবে। বিশ্বের অর্থনৈতিক পরিচালনা ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার ইতিবাচক ও গঠনমূলক তাত্পর্য রয়েছে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।
এসময় লি খ্য ছিয়াং এআইআইবি'র সামনে তিন-দফা প্রস্তাব তুলে ধরেন। তিনি বলেন, নতুন এই উন্নয়ন ব্যাংককে 'এক অঞ্চল, এক পথ' কৌশলের সাথে বিভিন্ন দেশের উন্নয়নকৌশলকে সংযুক্ত করতে এবং আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে হবে। তিনি পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় দেওয়ার ওপরও গুরুত্বারোপ করেন।
২০০৮ সালে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে সংকট দেখা দেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত বিশ্ব অর্থনীতিতে অনেক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দেওয়ার ফলে, অনেক উন্নয়শীল দেশের অবকাঠামো ও নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমে যায়। আমরা জানি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অবকাঠামো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রেক্ষাপটেই এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয়।
বর্তমানে বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ আঞ্চলিক উন্নয়ন ব্যাংকগুলো বিশ্ব অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। এসব উন্নয়ন ব্যাংকের পরিচালন-ব্যবস্থায় চীনসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে এসব ব্যাংকের নীতি নির্ধারণে এশিয়ার তথা উন্নয়নশীল বিশ্বের মতামত তেমন একটা গুরুত্ব পায়নি।
এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক এশিয়াভিত্তিক একটি বহুপক্ষীয় উন্নয়ন সংস্থা এবং এর আইনানুগ সম্পদ ১০০ বিলিয়ন বা ১০,০০০ কোটি ডলার। এ ব্যাংকের সদরদপ্তর চীনের রাজধানী বেইজিংতে অবস্থিত। এ ব্যাংক এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ খাততে সমর্থন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব দেন এবং ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি আনুষ্ঠিতভাবে এ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়। বিগত ২৭ মাসে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতাদেশ ৫৭টি। চীনা জাতীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিশন বৈদেশিক অর্থনীতি গবেষণালয়ের গবেষক ছাং চিয়ান পিং মনে করেন, এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠা বিশ্বের অধিকাংশ দেশের চাহিদা ও স্বার্থের সাথে সংগতিপূর্ণ। তিনি বলেন, "এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সদস্যদেশগুলো প্রয়োজনে অবকাঠামো নির্মাণ খাতে আর্থিক সমর্থন পেতে পারে এবং নিজ নিজ বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নত করতে পারবে। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক এ প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতার মাধ্যমে ভবিষ্যতে সার্বিক আঞ্চলিক সহযোগিতার জন্য পরিবেশও সৃষ্টি করবে।"
পুঁজি আধুনিক অর্থনীতির ভিত্তি। এর আগে সদস্য হিসেবে চীন বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকে যোগ দিয়েছে। তবে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীন প্রথমবারের মতো নীতি-নির্ধারক হিসেবে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রশাসনে অংশ নিচ্ছে। এতে বিশ্ব অর্থনৈতিক প্রশাসনে চীনের কথা বলার অধিকার যেমন বাড়বে, তেমনি তাকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অধিক হারে দায়িত্বও পালন করতে হবে।
ছাং চিয়ান পিং বলেন, "যৌথ আলোচনা, নির্মাণ ও ভাগাভাগি আমাদের মূলনীতি। দেশ যত বড় বা ছোট হোক—আমাদের দৃষ্টিতে সবাই সমান মর্যাদার। মতৈক্যে পৌঁছানোর ভিত্তিতে আমরা সহযোগিতা করব এবং এমন একটি ধারণা বর্তমান বিশ্ব উন্নয়নের প্রবণতা।"
অবকাঠানো নির্মাণে চীনের প্রচুর অভিজ্ঞতাও অন্য দেশগুলোকে আকর্ষণ করেছে। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মার্টিন জ্যাকস্ বলেছেন, যদি বিশ্বে অবকাঠামো নির্মাণ খাতে কোনো বিশেষজ্ঞ-দেশ থেকে থাকে, তবে সেটা অবশ্যই চীন।
২০১৫ সালের ২৯ জুন, 'এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক চুক্তি' স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত হয়। এটা এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের মৌলিক আইন হিসেবে গণ্য। এ চুক্তি অনুযায়ী, ব্যাংকের চীনের শেয়ার ৩০.৩৪ শতাংশ এবং ভোটের অধিকার ২৬.০৬ শতাংশ। তার মানে চীন ব্যাংকের বৃহত্তম শেয়ার হোল্ডার এবং এতে চীনের মত সবচে' বেশি গুরুত্ব পাবে। ২০১৫ সালের ২৫ ডিসেম্বর, ৫০.১ শতাংশ শেয়ারের মালিক ১৭টি প্রতিষ্ঠাদেশে এ চুক্তি অনুমোদন করা হয়। আর এর মাধ্যমেই এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়।
তবে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের জন্য এটা মাত্র একটি শুরু। অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক হিসেবে সদস্যদেশগুলোর চাহিদা পূরণ এবং নিরাপদে ঋণ বিতরণ ও তা উদ্ধার খুবই জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। বিশ্ব ব্যাংক ও এশিয়া উন্নয়ন ব্যাংকের চেয়ে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংকের কাঠামো ভিন্ন। আসলে, চীন এমন একটি ব্যাংক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বিদ্যমান বৈশ্বিক ব্যাংক ব্যবস্থায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন আনতে চায় না। চীন চায়, বিদ্যমান আর্থিক ব্যবস্থার পরিপূরক হিসেবে কাজ করবে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক। কীভাবে? একটা উদারহণ দিচ্ছি। ২০১৪ সালে বিশ্ব ব্যাংক উন্নয়শীল দেশগুলোকে ৬১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে। অথচ এর মধ্যে মাত্র ২৪০০ কোটি ডলার দেওয়া হয়েছে অবকাঠামোর নির্মাণ খাতে। অথচ সে বছর বিশ্বে অবকাঠামো নির্মাণ খাতে পুঁজির চাহিদা ছিল ১৫০,০০০ কোটি ডলার। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক এই ব্যাপক চাহিদা পূরণে লক্ষ্য নিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বিশ্ব ব্যাংকের গভর্নর জিম ইয়ং কিম এ প্রসঙ্গে বলেন, "যে সংস্থা-ই অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ করবে, আমার কাছে সে-ই বন্ধু ও সহযোগী। এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক বিশ্ব অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বিনিয়োগ করবে। এটা খুবই অর্থবহ।"
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের আনুমানিক হিসেব অনুযায়ী, আগামী ১০ বছরে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ খাতে ৮০০,০০০ কোটি ডলারের চাহিদা আছে। বলা বাহুল্য, বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এ চাহিদা পূরণ করতে পারবে না। এ ক্ষেত্রে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। (শিশির/আলিম)